প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার কোন সার্টিফিকেট নেই; নেই কোন কোটাও


‘‘প্রসঙ্গ যখন মুক্তিযোদ্ধা কোটা, আমার সেখানে চুপ করে থাকা মানায় না। ছোট বেলা থেকে বোনদের দেখেছি, আব্বার প্রতি হালকা একটা ক্ষোভ পোষণ করতে। আব্বা কোনদিন আমাদের তাঁর মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটের সুবিধা নিতে দেন নি। মেঝো যখন পরপর দুইবার বিসিএস এর ভাইভা দিয়েও ফিরে এলো, তখন তাকে দেখলাম আব্বার সাথে এই বিষয়ে তর্কে যেতে। কিন্তু আব্বার কাঠিন্য এবং নীরবতা দেখে আপু কথা বাড়াতে পারেনি। সবার ছোট বলে আব্বার সাথে আমার দুরত্ব ছিলো কম। আমার নিজের এসএসসিতে ৪.৯৪ পাবার পরে ভিকারুননেসা/ আইডিয়ালে চান্স না পেয়ে ভর্তি হলাম এক অখ্যাত কলেজে। মুক্তিযোদ্ধা কোটা সহজেই পারতো আমার স্বপ্নের কলেজে আমাকে একটা সিট জোগাড় করে দিতে। আমিও তাই একদিন আব্বার সামনে দাঁড়ালাম। একই ক্ষোভ নিয়ে। আব্বা তাঁর পাঁচ সন্তানের মধ্যে আমার কাছেই সর্বপ্রথম এই বিষয়ে মুখ খুললেন।বললেন-
‘শোন, আমি যুদ্ধ করেছি, তখন সেইটা দেশের জন্য দরকার ছিলো বলে। যখন যুদ্ধ করেছি, তখন আমার বাচ্চারা এটার ফায়দা নিবা, এইটার জোরে চাকরীতে সুবিধা নিবা, ভালো কলেজে সিট নিবা, এইটা ভেবে যুদ্ধ করি নাই। তোমরা জীবনে যা করবা, নিজের যোগ্যতায় করবা, কারো দয়া পাবার জন্য তাকায় থাকবা না। তোমরা কখনো কোটার সুযোগ নিতে চেয়ে আমাকে অপমান করবা না। তোমাদের আমি যোগ্য করে গড়ে তুলতেছি। আমার বাচ্চাদের উপরে আমার বিশ্বাস আছে।’
আমি নিজে আমার পরিচিতদের মধ্যে আদিবাসী কোটা, মুক্তিযোদ্ধা কোটার অপব্যবহারের চরম পর্যায় দেখে ফেলেছি। নিজেরা তেমন একটা অসুবিধায় না থাকা স্বত্বেও এই দুই কোটায় আমার চেনা জানা অনেকেই ভর্তি, চাকরী, বৃত্তি/ অনুদান বাগিয়ে নিয়েছে। বিশেষ করে অনুদানের ব্যপারে বলবো, অনেক সাধারণ ছাত্রের ঐ টাকাটা তাঁদের চেয়ে অনেক বেশি দরকার ছিলো। শুধু যদি সিট পাওয়াতেই ব্যপারটা শেষ হয়ে যেতো... অনেকে নিজে কতটুকু মেধা বহন করে, তা ভুলে গিয়ে কোটায় সিট দখল করে তাদের চেয়ে মেধাবী কিন্তু অ-কোটাধারীকে দুকথা শুনিয়ে দিতেও ছাড়ে না। একজন বীরের সন্তানের এই মানসিকতা কতটুকু সমর্থন করা যায়?
তারা তাদের পিতার দর্শনের কতোটুকু ধারণ করেছে তা বাদবাকী সবাই খুব ভালো বুঝলেও শুধু তারাই বুঝতে চায় না,
সিট দখলের দম্ভে। যদি আমার কথা বলি, আমার চাইতে মেধাবী/ যোগ্যতর কারো কাছে পরাজিত হতে আমার কোন গ্লানী নেই। যে লড়াইটা ছিল মাতৃভূমির জন্য, জন্মপরিচয়ের জন্য, সেই লড়াইয়ের দোহাই এইসব সামান্য ভর্তিযুদ্ধ, চাকরী যুদ্ধে দেখিয়ে আমরা মুক্তিযোদ্ধার সম্মান কতটা রক্ষা করছি, আর কতটা অপমান করছি, সেটা আজকে সাধারণ ছেলেমেয়েদেও পথে নেমে আসা দেখেই বোঝা যায়। জাতির শ্রেষ্ঠবীরদেরঔরসে জন্মে কূপমন্ডূক সন্তান হয়ে থাকার চেয়ে আত্মসম্মান নিয়ে সাধারণের কাতারে দাঁড়ানো অনেক ভালো।’’
এভাবে ভাবতে তৈরি আমাদের রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজনীতি-শিক্ষানীতি-কূটনীতি-স্বাধীননীতি-সুনীতি সচেতন নতুন প্রজন্ম। তারা তাদের অভিভাবকদের করা দেশের জন্য নিবেদিত মুক্তিযুদ্ধকে নিজেদের জন্য নিবেদিত দেখতে চায় না। তারা চায় যোগ্যতা- মেধা এবং দক্ষতার মাধ্যমে প্রতিটি স্তরে সফল হতে। মুক্তিযোদ্ধার পরিচয়, আদিবাসীর পরিচয় অথবা অন্য কোন পরিচয়ে আর কারো করুণার পাত্র হতে চায় না। যে কারনে নতুন প্রজন্ম জেগেছে নিজেদের চেতনার আন্দোলনে, নেমেছে সবার অধিকার সমান অধিকারের আন্দোলনে। কোটা ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে ‘না’ বলে তারা বেরিয়ে এসেছে রাজপথে। এই পথে তাদের সাথে আছে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানগণও। তাঁরা তৈরি বৈরি শিক্ষা ব্যবস্থাকে কোটা ভিত্তিক জায়গা থেকে সরিয়ে সমান অধিকারের সারিতে নিয়ে আসার জন্য। আর এ কারনেই ৩৪তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় বাদ পড়া শিক্ষার্থীরা কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে শাহবাগ মোড়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন থযাযাদি৩৪তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফল পুনর্মূল্যায়নের দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধকারীদের অবস্থান কর্মসূচি চলবে বলে জানিয়েছেন পরীক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ৩৪তম বিসিএস প্রিলিমিনারির ফল স্থগিত করে তা পুনর্মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (বিপিএসসি)।
অসংখ্য শিক্ষার্থী পিএসসির এই সিদ্ধান্ত না মেনে শাহবাগে অবস্থানের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তারা সংবাদ সম্মেলন করে কয়েক দফা দাবি তুলে ধরেন। তাদের প্রথম দাবি হলো, চাকরিতে বিদ্যমান সব ধরনের কোটা বাতিল করে শুধু মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সব নিয়োগ দিতে হবে। দ্বিতীয় দাবি, ৩৪তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফল বাতিল করতে হবে। এই দুটি দাবীর সাথে সম্পূর্ণ একমত আমি। আমি মনে করি, মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন করেছিলেন বৃহৎ স্বার্থে। সেই স্বার্থের জন্য নিবেদিত হয়েছে লাখ লাখ প্রাণ। সম্ভ্রম হারিয়েছেন লাখ লাখ মা- বোনেরা। তাদের সেই নিবেদনে কোন প্রাপ্তীর প্রত্যাশা লেশ মাত্রও ছিলো না। অতএব, বাংলাদেশের রাজনীতিকরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে রাজনীতি করে, যে বাণিজ্য করে, সে বাণিজ্য বন্ধের প্রথম স্তর এই আন্দোলন। আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা হলেও সারা জীবন যেমন শিখিয়েছেন স্বাধীনতার জন্য নিবেদিত থাকতে, তেমনি শিখিয়েছেন আর দশটা মানুষের মত স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে। বাবা মুক্তিযোদ্ধা বলে কোথাও একটু বেশি অধিকার পাওয়ার জন্য চেষ্টা করতে বারণ করেছেন। কেননা, বাবা বলতেন, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার কোন সার্টিফিকেট নেই; নেই কোন কোটাও। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার মনে আছে দেশের জন্য নিবেদিত তাঁর সবটুকু ভালোবাসা-সাহস আর স্বপ্ন। অতএব, বাংলাদেশে স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এই কোটা রীতি বন্ধের যে শিক্ষা শৈশব থেকে পেয়ে এসেছি। সেই শিক্ষার সূত্র ধরে মেধা চত্বরের রাজনীতি নয়; শিক্ষানীতি নিয়ে এই এগিয়ে চলায় আমি একমত।
আমি মনে করি, কেউ ৮০ পেয়ে পাস করবে না, আর কেউ ৫০ পেয়ে পাস করবে এই প্রহসন মেনে নেয়া যায় না। পিএসসির কিছু অত্যুৎসাহী সদস্য সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এ কাজ করেছে। সাধারণ ক্যাডারের ৪৪২টি পদসহ মোট ২ হাজার ৫২টি পদে নিয়োগ দিতে গত ৭ ফেব্রুয়ারি ৩৪তম বিসিএসের বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। ২ লাখ ২১ হাজার ৫৭৫ জন প্রার্থী এই পরীক্ষার জন্য অনলাইনে আবেদন করেন। গত ২৪ মে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ১ লাখ ৯৫ হাজার পরীক্ষার্থী এতে অংশ নেন। গত সোমবার এই পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয় এবং মোট ১২ হাজার ৩৩ জন উত্তীর্ণ হন। এতদিন প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার পর চূড়ান্ত পর্যায়ে কোটা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হতো। কিন্তু ৩৪তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পর্যায় থেকেই কোটা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে। এতে মেধাবীদের একটি বড় অংশ শুরুতেই সরকারি চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
আমার রাজনৈতিক পরিচয়ের কারনে নতুন প্রজন্মের মেধা চত্বরে অনেকের সাথেই কথা হয়েছে। একজন অভিযোগ বলেছেন, এতে কম নাম্বার পেয়েও অনেকে মুক্তিযোদ্ধা, আদিবাসী ও নারী কোটায় লিখিত পরীক্ষার জন্য নির্বাচিত হয়ে যাবেন। আর অপেক্ষাকৃত বেশি নাম্বার পেয়েও এই কোটার বাইরের অনেকে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন। এবার শুরু থেকেই কোটা হিসাবে প্রার্থী নেয়ায় অনেক মেধাবী প্রতিযোগী বঞ্চিত হয়েছেন। এই বঞ্চনা আমরা চাই না। চাই সমঅধিকার। যোগ্যতা- মেধা আর দক্ষতার মাধ্যমে বিসিএস-এ আমাদের আগামী তৈরি হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। আর এ জন্য সবার আগে কোটা প্রথা বাতিল করা হোক। তা না হলে আমরা কোটা প্রথার মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধার অযোগ্য- মেধাহীন সন্তানদেরকে দেশের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা পদে দেখতে পাবো। যা বাংলাদেশের সুন্দর আগামীকে অন্ধকারে ঢেকে দেয়ার জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে ভালোবাসতেন, দেশের মানুষকে ভালোবাসতেন। তিনি বেঁচে থাকলে যেমন আজ কোটা প্রথা থাকতো না; তেমনি তাঁর মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটু ভেবে দেখলে-একটু দৃষ্টি দিলে এই বৈষম্য থাকতো না। অতএব, বাংলাদেশকে সত্যিকারের সোনার বাংলাদেশ হিসেবে বিনির্মাণের জন্য নিবেদিত শেখ হাসিনা প্রতি অনুরোধ বাতিল করুন সকল স্তরের এই কোটা প্রথা। তা না হলে যে ক্ষতি আপনি দেশ ও মানুষের করবেন, সেই ক্ষতি কখনোই পূরন হবে না। অতএব, ভেবে দেখুন এখনই...

Comments

Popular posts from this blog

বিসিএস পছন্দর ক্ষেত্রে প্রথম প্রশাসন কেন? দেখুন কোন ক্যাডারের পদোন্নতি কেমনভাবে হয় বা কোথায় থেকে কোথায় পোস্টিং

WiFi Password হ্যাক করেন সহজে । ( Free Software + ScreenShot )

মনীষীদের বাণী- উক্তি