কোটার ‘বিষ’ আর কত কাল?
সাইফুল আহমেদ :রাইজিংবিডি ডট কম
Published:31 Aug 2015 12:57:17 PM Monday || Updated:31 Aug 2015 02:47:43 PM Monday
কোটার ‘বিষ’ আর কত কাল?
সাইফুল আহমেদ : গত শনিবার প্রকাশিত হলো ৩৪তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফল। এতে মোট ২ হাজার ১৫৯ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে সুপারিশ করা হয়েছে। গত সাতটি বিসিএসে মেধা কোটা ও মুক্তিযোদ্ধা কোটায় উত্তীর্ণদের চূড়ান্ত ফলে আলাদা করা হলেও এবার তা হয়নি। এ কারণে মেধায় কতজন ও কোটায় কতজন রয়েছেন, প্রকাশিত ফলে তা স্পষ্ট নয়। এ ছাড়া প্রার্থী না পাওয়ায় কোটার কতটি পদ সংরক্ষিত রাখতে হয়েছে, তা-ও উল্লেখ করা হয়নি। এ কারণে বিভিন্ন কোটার কয়েকজন প্রার্থী বলছেন, এবার ফলে মেধা ও কোটা উল্লেখ না করায় কোটা পুরোপুরি মানা হয়েছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। আর কোটায় নন এমন কয়েকজন প্রার্থী বলছেন, মেধা ও কোটা আলাদা করলে স্বচ্ছতা থাকত।
এ ব্যাপারটি নিয়ে যেমন বিসিএসে ক্যাডারপ্রাপ্ত ও ক্যাডার-না-প্রাপ্তদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ রয়েছে, তার চেয়ে বড় ক্ষোভ রয়েছে বিসিএস ও অন্যান্য সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা নিয়ে। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় চাকরিপ্রার্থী ও শিক্ষার্থীরা আন্দোলন পর্যন্ত করেছেন। আর আন্দোলন করতে গিয়ে হতে হয়েছে সরকারি দলের সমর্থক কিংবা পুলিশি নির্যাতনের শিকার। চাকরিপ্রার্থীদের জন্য কোটা যেন ‘বিষের’ সমান হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই কোটার বিষ আর কতকাল পান করতে হবে?
বর্তমানে দেশে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ৫৬ শতাংশ কোটার কথা বলা আছে। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারী ও জেলা কোটা ১০ শতাংশ করে, পাঁচ শতাংশ কোটা রাখা হয়েছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য, আর প্রতিবন্ধীদের জন্য রয়েছে এক শতাংশ কোটা। বাকি ৪৪ শতাংশ মেধা কোটায় বরাদ্দ।
একটি দেশে কোটা পদ্ধতি বরাদ্দ দেওয়া হয় সাধারণত অনগ্রসর জনগণকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য। সেক্ষেত্রে নারীদের জন্য ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য পাঁচ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য এক শতাংশ, এই ১৬ শতাংশ কোটা নিয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই। তবে ১০ শতাংশ জেলা কোটা কিংবা মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা নিয়ে অধিকাংশ চাকরিপ্রার্থী ও শিক্ষার্থীর আপত্তি।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে যেসব মানুষ রক্ত দিয়েছেন, পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে আমাদেরকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দেওয়ার জন্য যারা প্রাণপণ লড়াই করেছেন, তাদের রক্তের প্রতিদান আমাদেরকে অবশ্যই দিতে হবে। এ বিষয়ে রাজাকার ব্যতীত কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়।
কথা হলো, একজন সৎ লোক প্রতিদান পাওয়ার জন্য কখনো নিজেকে সৎকর্ম প্রবৃত্ত করেন না। তা করলে তার সততা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করে অনেকে প্রাণ দিয়েছেন, শারীরিকভাব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, অনেকে আবার সুস্থ অবস্থায় দেশ স্বাধীন করেছেন। তাদের কেউই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সুবিধা ভোগ করবেন, সেই মনোবৃত্তি থেকে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেননি। তারা যুদ্ধ করেছেন আবেগের জায়গা থেকে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের নিষ্পেষণ থেকে দেশের মানুষকে মুক্তি করার জন্য, দেশকে স্বাধীন করার জন্য। তাদের প্রতি আমরা বিনম্র শ্রদ্ধাবনত। তাদের অবদানের প্রতিদান কোনোদিনও কিছু দিয়ে দেওয়া যাবে না।
এসব মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কিংবা নাতি/নাতনিদের চাকরিতে বিশেষ কোটা সুবিধা পাওয়ার ব্যাপারটি যদিও ‘সৎ লোকের সন্তানের তার বাবার সৎকর্মের প্রতিদান দাবির’ মতো ঘটনা, তারপরও সে সুবিধা নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা থাকত না যদি তা মাত্রাতিরিক্ত না হতো। স্বাধীনতা যুদ্ধে বাবার অবদানের জন্য মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের সুবিধা আমরা স্বপ্রণোদিত হয়ে দেব। তারা যদি চাকরি-বাকরিতে বিশেষ সুবিধা পায়, তাতে কারো কোনো আপত্তি নেই। তবে সেটি কতটুকু? আর যাই হোক ৩০ শতাংশ হতে পারে না! আর মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরাই বা কেন সেই সুবিধা পাবে?
বিসিএস কিংবা অন্যান্য সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সাম্প্রতিককালে লক্ষ্য করা গেছে, মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত ৩০ শতাংশ কোটা অনেকক্ষেত্রেই যোগ্য প্রার্থীর অভাবে পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। গত ২১, ২২ ও ২৫তম বিসিএসে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত কোটার যথাক্রমে ১০ দশমিক ৮, ২ দশমিক ২ ও ৫ দশমিক ২ ভাগ পূর্ণ হয়। আর ২৮তম বিসিএসে পেশাগত ও কারিগরি ক্যাডারে বিভিন্ন কোটায় ৮১৩টি পদের জন্য কোনো যোগ্য প্রার্থীই পাওয়া যায়নি। মুক্তিযোদ্ধা, নারী, উপজাতি কোটা ও পেশাগত ক্যাডারে যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায় ২৮তম বিসিএসে ৮১০টি এবং ২৯তম বিসিএসে ৭৯২টি পদ খালি থাকে। পরে এসব পদে নিয়োগ দিতে ৩২তম বিশেষ বিসিএস হয়। এবারও হয়তো মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা পূরণ হয়নি বলেই পিএসসি মেধা ও অন্যান্য কোটা আলাদা করে ফল প্রকাশ করেনি। যেখানে মেধাবীরা ভালো পরীক্ষা দিয়েও বিসিএসে কিংবা অন্যান্য সরকারি চাকরিতে সুযোগ পাচ্ছে না, সেখানে মুক্তিযোদ্ধা কোটা অপূরণ থাকায় লোক না নেওয়াটা প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়। এটি দেশে বেকারত্ব বাড়াচ্ছে, যুবকদেরকে হতাশার পথে ঠেলে দিচ্ছে।
তারপরও হয়তো মুক্তিযোদ্ধার স্বজনদের জন্য সংরক্ষিত ৩০ শতাংশ কোটা নিয়ে কারো কোনো প্রশ্ন থাকত না, যদি বৈধ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা এর সুফল পেতেন। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধার স্বজনদের জন্য কোটা বরাদ্দ এবং এমন লোকদের জন্য চাকরিতে বয়সে বিশেষ সুবিধা প্রণয়নের পর থেকে দেশে ‘মুক্তিযোদ্ধার’ সংখ্যা ভয়ানক হারে বেড়ে গেছে। দেখা যাচ্ছে, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা নানা বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন, অথচ বহু স্বার্থান্বেষী মানুষ অসদুপায়ে তার নিজের, বাবার কিংবা দাদা/নানার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ বের করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বা তার সন্তান/নাতি/নাতনি হয়ে যাচ্ছেন।
সম্প্রতি বিভিন্ন উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ করে নিজেদের চাকরির মেয়াদ বাড়িয়েছন এবং এ রকম বেশ কয়েকটি ঘটনা ধরাও পড়েছে। এর সবশেষ প্রমাণ হলেন প্রতিমন্ত্রী পদ-মর্যাদার বেসরকারিকরণ কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান। রোববার, ৩০ আগস্ট তার মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। তিনি বলেন, ‘মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানের মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও গেজেট বাতিল করা হয়েছে। তিনি যে মুক্তিযোদ্ধা, এর পক্ষে যুক্তি-প্রমাণ দিতে পারেননি। তার সনদ ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে।’
মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানের মতো আরো বহু ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন যারা নিজেরা কিংবা তাদের সন্তান/নাতি/নাতনিরা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদের মাধ্যমে বিশেষ সুবিধা ভোগ করছেন। নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, টিউশন কিংবা পার্ট টাইম চাকরি করে বহু কষ্টে পড়াশোনা করেও চাকরি পাবে না, আর অমেধাবীরা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেখিয়ে বিসিএসের মতো চাকরি পেয়ে যাবে, তা কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন চাকরি ব্যবস্থাপনায় অন্যায় হচ্ছে, অন্যদিকে অনেক অমেধাবীরা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে যাচ্ছে, ফলে দেশ একটি ‘মেধাশূন্য’ ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার স্বজন কিংবা অন্যান্য কোটাধারীরা যে মেধাশূন্য, বিষয়টি তেমন নয়। অনেক মুক্তিযোদ্ধার সন্তান/নাতি/নাতনি কিংবা অন্য কোটাধারীও প্রচণ্ড মেধাবী। তারা সরকারি চাকরিতে মেধার প্রমাণ রেখে জায়গা করে নিচ্ছেন। তবে সেক্ষেত্রেও একটি অসুবিধা আছে। সেটি হলো, তারা জায়গা করে নিচ্ছেন ৪৪ শতাংশ মেধা কোটায়। তাদেরকে প্রাধিকার কোটায় গণ্য করা হচ্ছে না। ফলে কোনো ধরনের কোটা নেই এমন মেধাবীদের জায়গা আরো সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির প্রয়োগ নতুন কিছু নয়। ব্রিটিশ শাসনামল এবং পাকিস্তান জামানা পেরিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরও চাকরিতে কোটা পদ্ধতি চালু রাখার সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩২ বছর করা হয়। ওই সময় তাদের অবদান ও বিড়ম্বনার কথা বিবেচনা করে এটি সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার দীর্ঘ দিন পরেও জন্ম নেওয়া তাদের সন্তান কিংবা নাতি/নাতনির বেলায় এটা প্রয়োগের কোনো যুক্তি কি আদৌ আছে? সংবিধানে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির কথা বলা হলেও সেই অনগ্রসর জনগোষ্ঠী কারা এবং কত দিন ধরে তাদের কোটা দেওয়া যেতে পারে তা নতুন করে ভাবতে হবে।
১৯৭২ সালে ২০ শতাংশ মেধা, ৪০ শতাংশ জেলা, ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা আর ১০ শতাংশ যুদ্ধবিধ্বস্ত নারী কোটা ছিল। ১৯৭৬-এ তা পরিবর্তন করে মেধা ৪০ শতাংশ আর জেলা কোটা ২০ শতাংশ করা হয়। ১৯৮৫-তে মেধা ৪৫ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা ৫ শতাংশ করা হয়। প্রথম থেকেই মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ ছিল। পরে এ কোটার সুযোগ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও পরবর্তীতে নাতি/নাতনিদেরও দেওয়া হয়।
যখন জেলা কোটা চালু হয়েছিল তখন জেলা ছিল ১৯টি। এখন ৬৪টি। অথচ কোনো কোনো নিয়োগে ৬৪টি পদই থাকে না। আবার বেশিরভাগ সময় মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় পদ খালি থাকে। কিন্তু সংরক্ষিত হওয়ার কারণে এ পদগুলোতে মেধাভিত্তিক নিয়োগ সম্ভব হয় না।
১৯৭৭ সালে তৎকালীন পে ও সার্ভিস কমিশনের একজন সদস্য বাদে সবাই সরকারি নিয়োগে কোটাব্যবস্থার বিরোধিতা করেন। কোটার পক্ষে অবস্থা নেওয়া এম এম জামান প্রচলিত কোটাগুলো প্রথম ১০ বছর বহাল রেখে ১৯৮৭ সাল থেকে পরবর্তী ১০ বছরে ধীরে ধীরে কমিয়ে দশম বছরে তা বিলুপ্ত করার পক্ষে মত দেন। কিন্তু পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালেই এই কোটাব্যবস্থাকে আরো সম্প্রসারিত করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের এর আওতাভুক্ত করা হয়।
সরকারি চাকরিতে কোটা প্রক্রিয়াটি কখনো সরল-সোজা ছিল না, ফলে স্বাভাবিকভাবেই জটিলতা সৃষ্টি করে। ক্ষেত্রবিশেষে তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহৃত হয়। তাই কোটা ব্যবস্থা নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা ও প্রয়োজনীয় সংস্কার জরুরি। এটা সত্য, কোটা ব্যবস্থা একেবারে বাতিল হওয়ার পর্যায়ে এখনো আমরা উপনীত হইনি। তবে বিদ্যমান আনুপাতিক হার কমিয়ে যৌক্তিক অবস্থায় আনতে হবে। সমাজের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে তাদের প্রাধান্য দিতে হবে। মুক্তিযোদ্ধা কোটার ক্ষেত্রে একটি নীতিমালা থাকা জরুরি। সেক্ষেত্রে কোটা শুধু গরিব ও দুস্থ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে। সব মিলিয়ে এ মুহূর্তে প্রাধিকার কোটা ৩০ শতাংশের বেশি গ্রহণযোগ্য নয়। সেক্ষেত্রে, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের স্বজনদের জন্য ১৫ শতাংশ এবং নারী, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, ও প্রতিবন্ধীদের জন্য বাকি ১৫ শতাংশ রাখা যেতে পারে।
গত মার্চে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিদের কোটা ও জেলা কোটা বন্ধের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে কমিটির সদস্য রআম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী মতামত দেন যে, ‘অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর ব্যাপারে যে কোটা রয়েছে তাতে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের নামে যে কোটা মানা হচ্ছে এবং জেলাভিত্তিক যে কোটা অনুসরণ করা হচ্ছে সেটি উঠিয়ে দেওয়া উচিত। মুক্তিযোদ্ধাদের কোটাটি বড়জোর সন্তান পর্যন্ত রাখা যেতে পারে। কিন্তু নাতি-নাতনি কিংবা পুতিদের এসব সুবিধা দেওয়া একেবারেই উচিত নয়।’
ব্যক্তিগতভাবে আমি, একেবারে কোটা বিরোধী নই। দেশের অনগ্রসর জনগোষ্ঠিকে এগিয়ে নিতে ও মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ, শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও অন্যান্য প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের স্বজনদের চাকরিতে বিশেষ সুবিধা দেওয়া যেতে পারে, তবে তা অবশ্যই সহনীয় পর্যায়ে থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, কোটা হলো বিশেষ ব্যবস্থা, অন্যদিকে মেধা কোটা হলো সাধারণ ব্যবস্থা। কোটা প্রবর্তন করা হয়, পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে সমতালে তোলার জন্য। তবে প্রাধিকার কোটা কোনোভাবেই মেধা কোটার চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এটা পাগলামি। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে কখনোই মূল (মেধাবী) জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত করা চলবে না, এটি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
সাধারণের বিপরীতে বিশেষ ব্যবস্থার আধিক্য জটিলতাই সৃষ্টি করবে। বছর কয়েক আগে পিএসসির এক বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রচলিত কোটা পদ্ধতির কারণে উপযুক্ত প্রার্থী নির্বাচন শতভাগ নিখুঁতভাবে করা সম্ভব নয়। বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে উপযুক্ত প্রার্থী মনোনয়নের জন্য বর্তমানে প্রচলিত কোটা পদ্ধতির সরলীকরণ অপরিহার্য। অন্যথায় কোটা প্রয়োগসংশ্লিষ্ট জটিলতা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।
সবশেষে বলতে চাই, স্বাধীনতার ৪৪ বছর পেরিয়ে গেছে। এখন আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হতে হবে, কীভাবে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া যায়। এ দেশ আমাদের সবার। এখানে কোনো বিভাজন কাম্য নয়। আর দেশকে এগিয়ে নিতে হলে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে মেধাবীদের স্থান পাওয়াটা খুবই জরুরি। কোটার ফাঁদে পড়ে মেধাবীরা যেন চাকরি বঞ্চিত না হয় এবং অমেধাবীরা যেন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে ঢুকে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। না হলে সর্বনাশ হবে আমাদের দেশেরই।
লেখক : সংবাদকর্মী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী।
Published:31 Aug 2015 12:57:17 PM Monday || Updated:31 Aug 2015 02:47:43 PM Monday
কোটার ‘বিষ’ আর কত কাল?
সাইফুল আহমেদ : গত শনিবার প্রকাশিত হলো ৩৪তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফল। এতে মোট ২ হাজার ১৫৯ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে সুপারিশ করা হয়েছে। গত সাতটি বিসিএসে মেধা কোটা ও মুক্তিযোদ্ধা কোটায় উত্তীর্ণদের চূড়ান্ত ফলে আলাদা করা হলেও এবার তা হয়নি। এ কারণে মেধায় কতজন ও কোটায় কতজন রয়েছেন, প্রকাশিত ফলে তা স্পষ্ট নয়। এ ছাড়া প্রার্থী না পাওয়ায় কোটার কতটি পদ সংরক্ষিত রাখতে হয়েছে, তা-ও উল্লেখ করা হয়নি। এ কারণে বিভিন্ন কোটার কয়েকজন প্রার্থী বলছেন, এবার ফলে মেধা ও কোটা উল্লেখ না করায় কোটা পুরোপুরি মানা হয়েছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। আর কোটায় নন এমন কয়েকজন প্রার্থী বলছেন, মেধা ও কোটা আলাদা করলে স্বচ্ছতা থাকত।
এ ব্যাপারটি নিয়ে যেমন বিসিএসে ক্যাডারপ্রাপ্ত ও ক্যাডার-না-প্রাপ্তদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ রয়েছে, তার চেয়ে বড় ক্ষোভ রয়েছে বিসিএস ও অন্যান্য সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা নিয়ে। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় চাকরিপ্রার্থী ও শিক্ষার্থীরা আন্দোলন পর্যন্ত করেছেন। আর আন্দোলন করতে গিয়ে হতে হয়েছে সরকারি দলের সমর্থক কিংবা পুলিশি নির্যাতনের শিকার। চাকরিপ্রার্থীদের জন্য কোটা যেন ‘বিষের’ সমান হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই কোটার বিষ আর কতকাল পান করতে হবে?
বর্তমানে দেশে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ৫৬ শতাংশ কোটার কথা বলা আছে। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারী ও জেলা কোটা ১০ শতাংশ করে, পাঁচ শতাংশ কোটা রাখা হয়েছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য, আর প্রতিবন্ধীদের জন্য রয়েছে এক শতাংশ কোটা। বাকি ৪৪ শতাংশ মেধা কোটায় বরাদ্দ।
একটি দেশে কোটা পদ্ধতি বরাদ্দ দেওয়া হয় সাধারণত অনগ্রসর জনগণকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য। সেক্ষেত্রে নারীদের জন্য ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য পাঁচ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য এক শতাংশ, এই ১৬ শতাংশ কোটা নিয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই। তবে ১০ শতাংশ জেলা কোটা কিংবা মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা নিয়ে অধিকাংশ চাকরিপ্রার্থী ও শিক্ষার্থীর আপত্তি।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে যেসব মানুষ রক্ত দিয়েছেন, পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে আমাদেরকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দেওয়ার জন্য যারা প্রাণপণ লড়াই করেছেন, তাদের রক্তের প্রতিদান আমাদেরকে অবশ্যই দিতে হবে। এ বিষয়ে রাজাকার ব্যতীত কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়।
কথা হলো, একজন সৎ লোক প্রতিদান পাওয়ার জন্য কখনো নিজেকে সৎকর্ম প্রবৃত্ত করেন না। তা করলে তার সততা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করে অনেকে প্রাণ দিয়েছেন, শারীরিকভাব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, অনেকে আবার সুস্থ অবস্থায় দেশ স্বাধীন করেছেন। তাদের কেউই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সুবিধা ভোগ করবেন, সেই মনোবৃত্তি থেকে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেননি। তারা যুদ্ধ করেছেন আবেগের জায়গা থেকে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের নিষ্পেষণ থেকে দেশের মানুষকে মুক্তি করার জন্য, দেশকে স্বাধীন করার জন্য। তাদের প্রতি আমরা বিনম্র শ্রদ্ধাবনত। তাদের অবদানের প্রতিদান কোনোদিনও কিছু দিয়ে দেওয়া যাবে না।
এসব মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কিংবা নাতি/নাতনিদের চাকরিতে বিশেষ কোটা সুবিধা পাওয়ার ব্যাপারটি যদিও ‘সৎ লোকের সন্তানের তার বাবার সৎকর্মের প্রতিদান দাবির’ মতো ঘটনা, তারপরও সে সুবিধা নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা থাকত না যদি তা মাত্রাতিরিক্ত না হতো। স্বাধীনতা যুদ্ধে বাবার অবদানের জন্য মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের সুবিধা আমরা স্বপ্রণোদিত হয়ে দেব। তারা যদি চাকরি-বাকরিতে বিশেষ সুবিধা পায়, তাতে কারো কোনো আপত্তি নেই। তবে সেটি কতটুকু? আর যাই হোক ৩০ শতাংশ হতে পারে না! আর মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরাই বা কেন সেই সুবিধা পাবে?
বিসিএস কিংবা অন্যান্য সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সাম্প্রতিককালে লক্ষ্য করা গেছে, মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত ৩০ শতাংশ কোটা অনেকক্ষেত্রেই যোগ্য প্রার্থীর অভাবে পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। গত ২১, ২২ ও ২৫তম বিসিএসে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত কোটার যথাক্রমে ১০ দশমিক ৮, ২ দশমিক ২ ও ৫ দশমিক ২ ভাগ পূর্ণ হয়। আর ২৮তম বিসিএসে পেশাগত ও কারিগরি ক্যাডারে বিভিন্ন কোটায় ৮১৩টি পদের জন্য কোনো যোগ্য প্রার্থীই পাওয়া যায়নি। মুক্তিযোদ্ধা, নারী, উপজাতি কোটা ও পেশাগত ক্যাডারে যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায় ২৮তম বিসিএসে ৮১০টি এবং ২৯তম বিসিএসে ৭৯২টি পদ খালি থাকে। পরে এসব পদে নিয়োগ দিতে ৩২তম বিশেষ বিসিএস হয়। এবারও হয়তো মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা পূরণ হয়নি বলেই পিএসসি মেধা ও অন্যান্য কোটা আলাদা করে ফল প্রকাশ করেনি। যেখানে মেধাবীরা ভালো পরীক্ষা দিয়েও বিসিএসে কিংবা অন্যান্য সরকারি চাকরিতে সুযোগ পাচ্ছে না, সেখানে মুক্তিযোদ্ধা কোটা অপূরণ থাকায় লোক না নেওয়াটা প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়। এটি দেশে বেকারত্ব বাড়াচ্ছে, যুবকদেরকে হতাশার পথে ঠেলে দিচ্ছে।
তারপরও হয়তো মুক্তিযোদ্ধার স্বজনদের জন্য সংরক্ষিত ৩০ শতাংশ কোটা নিয়ে কারো কোনো প্রশ্ন থাকত না, যদি বৈধ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা এর সুফল পেতেন। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধার স্বজনদের জন্য কোটা বরাদ্দ এবং এমন লোকদের জন্য চাকরিতে বয়সে বিশেষ সুবিধা প্রণয়নের পর থেকে দেশে ‘মুক্তিযোদ্ধার’ সংখ্যা ভয়ানক হারে বেড়ে গেছে। দেখা যাচ্ছে, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা নানা বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন, অথচ বহু স্বার্থান্বেষী মানুষ অসদুপায়ে তার নিজের, বাবার কিংবা দাদা/নানার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ বের করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বা তার সন্তান/নাতি/নাতনি হয়ে যাচ্ছেন।
সম্প্রতি বিভিন্ন উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ করে নিজেদের চাকরির মেয়াদ বাড়িয়েছন এবং এ রকম বেশ কয়েকটি ঘটনা ধরাও পড়েছে। এর সবশেষ প্রমাণ হলেন প্রতিমন্ত্রী পদ-মর্যাদার বেসরকারিকরণ কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান। রোববার, ৩০ আগস্ট তার মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। তিনি বলেন, ‘মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানের মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও গেজেট বাতিল করা হয়েছে। তিনি যে মুক্তিযোদ্ধা, এর পক্ষে যুক্তি-প্রমাণ দিতে পারেননি। তার সনদ ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে।’
মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানের মতো আরো বহু ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন যারা নিজেরা কিংবা তাদের সন্তান/নাতি/নাতনিরা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদের মাধ্যমে বিশেষ সুবিধা ভোগ করছেন। নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, টিউশন কিংবা পার্ট টাইম চাকরি করে বহু কষ্টে পড়াশোনা করেও চাকরি পাবে না, আর অমেধাবীরা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেখিয়ে বিসিএসের মতো চাকরি পেয়ে যাবে, তা কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন চাকরি ব্যবস্থাপনায় অন্যায় হচ্ছে, অন্যদিকে অনেক অমেধাবীরা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে যাচ্ছে, ফলে দেশ একটি ‘মেধাশূন্য’ ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার স্বজন কিংবা অন্যান্য কোটাধারীরা যে মেধাশূন্য, বিষয়টি তেমন নয়। অনেক মুক্তিযোদ্ধার সন্তান/নাতি/নাতনি কিংবা অন্য কোটাধারীও প্রচণ্ড মেধাবী। তারা সরকারি চাকরিতে মেধার প্রমাণ রেখে জায়গা করে নিচ্ছেন। তবে সেক্ষেত্রেও একটি অসুবিধা আছে। সেটি হলো, তারা জায়গা করে নিচ্ছেন ৪৪ শতাংশ মেধা কোটায়। তাদেরকে প্রাধিকার কোটায় গণ্য করা হচ্ছে না। ফলে কোনো ধরনের কোটা নেই এমন মেধাবীদের জায়গা আরো সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির প্রয়োগ নতুন কিছু নয়। ব্রিটিশ শাসনামল এবং পাকিস্তান জামানা পেরিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরও চাকরিতে কোটা পদ্ধতি চালু রাখার সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩২ বছর করা হয়। ওই সময় তাদের অবদান ও বিড়ম্বনার কথা বিবেচনা করে এটি সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার দীর্ঘ দিন পরেও জন্ম নেওয়া তাদের সন্তান কিংবা নাতি/নাতনির বেলায় এটা প্রয়োগের কোনো যুক্তি কি আদৌ আছে? সংবিধানে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির কথা বলা হলেও সেই অনগ্রসর জনগোষ্ঠী কারা এবং কত দিন ধরে তাদের কোটা দেওয়া যেতে পারে তা নতুন করে ভাবতে হবে।
১৯৭২ সালে ২০ শতাংশ মেধা, ৪০ শতাংশ জেলা, ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা আর ১০ শতাংশ যুদ্ধবিধ্বস্ত নারী কোটা ছিল। ১৯৭৬-এ তা পরিবর্তন করে মেধা ৪০ শতাংশ আর জেলা কোটা ২০ শতাংশ করা হয়। ১৯৮৫-তে মেধা ৪৫ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা ৫ শতাংশ করা হয়। প্রথম থেকেই মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ ছিল। পরে এ কোটার সুযোগ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও পরবর্তীতে নাতি/নাতনিদেরও দেওয়া হয়।
যখন জেলা কোটা চালু হয়েছিল তখন জেলা ছিল ১৯টি। এখন ৬৪টি। অথচ কোনো কোনো নিয়োগে ৬৪টি পদই থাকে না। আবার বেশিরভাগ সময় মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় পদ খালি থাকে। কিন্তু সংরক্ষিত হওয়ার কারণে এ পদগুলোতে মেধাভিত্তিক নিয়োগ সম্ভব হয় না।
১৯৭৭ সালে তৎকালীন পে ও সার্ভিস কমিশনের একজন সদস্য বাদে সবাই সরকারি নিয়োগে কোটাব্যবস্থার বিরোধিতা করেন। কোটার পক্ষে অবস্থা নেওয়া এম এম জামান প্রচলিত কোটাগুলো প্রথম ১০ বছর বহাল রেখে ১৯৮৭ সাল থেকে পরবর্তী ১০ বছরে ধীরে ধীরে কমিয়ে দশম বছরে তা বিলুপ্ত করার পক্ষে মত দেন। কিন্তু পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালেই এই কোটাব্যবস্থাকে আরো সম্প্রসারিত করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের এর আওতাভুক্ত করা হয়।
সরকারি চাকরিতে কোটা প্রক্রিয়াটি কখনো সরল-সোজা ছিল না, ফলে স্বাভাবিকভাবেই জটিলতা সৃষ্টি করে। ক্ষেত্রবিশেষে তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহৃত হয়। তাই কোটা ব্যবস্থা নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা ও প্রয়োজনীয় সংস্কার জরুরি। এটা সত্য, কোটা ব্যবস্থা একেবারে বাতিল হওয়ার পর্যায়ে এখনো আমরা উপনীত হইনি। তবে বিদ্যমান আনুপাতিক হার কমিয়ে যৌক্তিক অবস্থায় আনতে হবে। সমাজের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে তাদের প্রাধান্য দিতে হবে। মুক্তিযোদ্ধা কোটার ক্ষেত্রে একটি নীতিমালা থাকা জরুরি। সেক্ষেত্রে কোটা শুধু গরিব ও দুস্থ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে। সব মিলিয়ে এ মুহূর্তে প্রাধিকার কোটা ৩০ শতাংশের বেশি গ্রহণযোগ্য নয়। সেক্ষেত্রে, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের স্বজনদের জন্য ১৫ শতাংশ এবং নারী, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, ও প্রতিবন্ধীদের জন্য বাকি ১৫ শতাংশ রাখা যেতে পারে।
গত মার্চে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিদের কোটা ও জেলা কোটা বন্ধের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে কমিটির সদস্য রআম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী মতামত দেন যে, ‘অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর ব্যাপারে যে কোটা রয়েছে তাতে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের নামে যে কোটা মানা হচ্ছে এবং জেলাভিত্তিক যে কোটা অনুসরণ করা হচ্ছে সেটি উঠিয়ে দেওয়া উচিত। মুক্তিযোদ্ধাদের কোটাটি বড়জোর সন্তান পর্যন্ত রাখা যেতে পারে। কিন্তু নাতি-নাতনি কিংবা পুতিদের এসব সুবিধা দেওয়া একেবারেই উচিত নয়।’
ব্যক্তিগতভাবে আমি, একেবারে কোটা বিরোধী নই। দেশের অনগ্রসর জনগোষ্ঠিকে এগিয়ে নিতে ও মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ, শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও অন্যান্য প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের স্বজনদের চাকরিতে বিশেষ সুবিধা দেওয়া যেতে পারে, তবে তা অবশ্যই সহনীয় পর্যায়ে থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, কোটা হলো বিশেষ ব্যবস্থা, অন্যদিকে মেধা কোটা হলো সাধারণ ব্যবস্থা। কোটা প্রবর্তন করা হয়, পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে সমতালে তোলার জন্য। তবে প্রাধিকার কোটা কোনোভাবেই মেধা কোটার চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এটা পাগলামি। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে কখনোই মূল (মেধাবী) জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত করা চলবে না, এটি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
সাধারণের বিপরীতে বিশেষ ব্যবস্থার আধিক্য জটিলতাই সৃষ্টি করবে। বছর কয়েক আগে পিএসসির এক বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রচলিত কোটা পদ্ধতির কারণে উপযুক্ত প্রার্থী নির্বাচন শতভাগ নিখুঁতভাবে করা সম্ভব নয়। বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে উপযুক্ত প্রার্থী মনোনয়নের জন্য বর্তমানে প্রচলিত কোটা পদ্ধতির সরলীকরণ অপরিহার্য। অন্যথায় কোটা প্রয়োগসংশ্লিষ্ট জটিলতা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।
সবশেষে বলতে চাই, স্বাধীনতার ৪৪ বছর পেরিয়ে গেছে। এখন আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হতে হবে, কীভাবে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া যায়। এ দেশ আমাদের সবার। এখানে কোনো বিভাজন কাম্য নয়। আর দেশকে এগিয়ে নিতে হলে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে মেধাবীদের স্থান পাওয়াটা খুবই জরুরি। কোটার ফাঁদে পড়ে মেধাবীরা যেন চাকরি বঞ্চিত না হয় এবং অমেধাবীরা যেন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে ঢুকে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। না হলে সর্বনাশ হবে আমাদের দেশেরই।
লেখক : সংবাদকর্মী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী।
I'm having a little issue I cant subscribe your feed, I'm using google reader fyi.
ReplyDeleteJust thought I would comment and say superb theme, did you create it yourself? Looks really good!
Can I put some of this on my page if I include a link to this website?
Ro water purifier
UF water purifier
Hydrogen water bottle
assume that there is such a thing as reality (ultimate or otherwise) – it is that assumption that is creating the problem, the suffering for you.
ReplyDeleteThat is just to make certain that your does not end up in the garbage can after a couple of days.
Sarah Berger
e post I tend to be of the same mind with most of what you wrote. I would love to see more posts on this. I will bookmark and come back.
ReplyDeleteThank you so much. Its very nice. I like it.:D
I findinshopbymark
u ought to really moderate the responses on this site
ReplyDeletePlease tell me that youre heading to keep this up! Its so good and so important. I cant wait to read much more from you. I just feel like you know so very much and knsodium hypochlorite amazon
china air purifier
korean air purifier brands
Keep it up, great job! Just the stuff I had to know.
ReplyDeleteI just added this page to my favorites. I enjoy reading your posts. Tyvm!
shopbymark